ভয় (Bhoy) - Short Story

ভয় (Bhoy) - Short Story

Feb 10, 2021

"ওহ্! কি শোনালি রে ভাই! ভয়ে বুক ধক্পক করছে এখনো!" রিতমা বুকে হাত রেখে হেসে উঠল।

 "অনেক কালেকশন আছে আমার কাছে, কত চাস্?" পৃথ্বীজিৎ তৃপ্তিভরে সিগারেট ধরাল একটা।

 ক্যাম্পিঙে এস্ছে তারা কয়েক বন্ধু, তামিল্নাডুর ছিমছাম পাহাড়ি শহর কোড়াইকানাল থেকে একটু ভেতরে, পাহাড়ের ওপর একটা নাম না জানা লেকের ধারে। পৃথ্বীজিৎ, রিতমা, সুদীপ্তা, কৌস্তভ আর আকাশ। ব্যাঙ্গালোরে থাকে সবাই, চাকরিসুত্রে। কলেজ থেকেই বন্ধুত্ব, একই শহরে চাকরি পেয়ে সেটা আরো প্রগাড় হয়েছে।

ক্রিসমাসের ছুটি সবারই ছিল, কৌস্তভ প্রস্তাবটা দেওয়ায় সবাই হৈহৈ করে লুফে নিয়েছে। ওরই গাড়িতে করে কোড়াইকানাল আসা। একটা হোম্স্টে বুক করে সেখানে প্রথম রাত থেকে আজ এই এডভ্যান্চার প্ল্যান করা হয়েছে।

লেকের ধারে কিছু শুকনো কাঠে আগুন জালিয়ে সবাই ঘিরে বসেছে। কৌস্তভের একটা ব​ড় টেন্ট আছে, সেটা পাশেই ফিট করে রাখা হ​য়ে গেছে। পাহাড়ে রাতটা তাড়াতাড়ি নামে, এমনিতেই চারদিক জনশুন্য ছিল, এখন মনে হচ্ছে ওরা ছাড়া যেন এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। এই অনন্ত কালো রাতে যতদূর চোখ যায় এই নির্বাক কালচে সবুজ গাছ্গুলো ছাড়া আর কেউ কোথাও নেই। মাঝেমাঝে এই নিস্তব্ধতা চিরে একটা দুটো জানোয়ারের ডাক শোনা যায়, তবে তারা জঙ্গলের বেশি ভেতরে যায়নি তাই সে ভয় নেই।

এই পরিবেশে ভুতের গল্প কার না ভাল লাগে! এদিকে ফোনের সিগন্যাল নেই তাই সময় কাটানোর আর কোনো উপায়ও নেই।

তো শুরু হয়ে গেলো ভূতের গল্পের আদান প্রদান। পৃথ্বীজিৎ আবার এই বিষয়ে একটু বেশী আগ্রহি, তাই তার কাছে অফুরন্ত গল্প। বাবার কাছে শোনা, মার কাছে শোনা, বন্ধুদের কাছে শোনা নানান গল্প। সবাই খুব আগ্রহে গিলছে একটার পর একটা গল্প।

"ভয় কাকে বলে তোরা জানিসইনা।" আকাশ আচম্কা মন্তব্য করল। ও বরাবরই একটু কম কথা বলে, আজকে এই আসরে এখন অবধি একটাও শব্দ করেনি ও। আগুন থেকে এক্টু দূরে, অন্ধকারের মধ্যে একটু মিশে বসে ছিল। পৃথ্বীর গল্প শেষ হতে ও কথাটা বলল।

 

"তুই জানিস নাকি ভয় কাকে বলে?" গল্পের নেশা কেটে যাওয়ায় সুদীপ্তা একটু বিরক্ত হল।

"দাঁড়া, দাঁড়া, একটু গল্পের গন্ধ পাচ্ছি মনে হচ্ছে!" আগ্রহে ঘুরে বসল কৌস্তভ।

"ধুর্, ও এমনি ফুটেজ খাচ্ছে!" পৃথ্বী মৃদু প্রতিবাদ করল, ওর ঝুলিতে আরো অনেক গল্প বাকি।

"বল না রে, কি রকম ভয়, পার্থিব নাকি অপার্থিব!" রিতমাও এবার ঘুরল আকাশের দিকে।

 

"তোদের খুব ভাল লাগে না, এই জনমানবহীন জায়গায়, অন্ধকারে বসে শুধু শুধু ভয় পেতে?" আকাশ উল্টো প্রশ্ন করল।

"হ্যাঁ, লাগে বইকি!" বলে হেসে উঠল রিতমা। বাকি সবাই ওর হাতে তালি বাজিয়ে আকাশের কটাক্ষটা হাওয়ায় উড়িয়ে দিল।

 

"কারণ তোরা জানিস্, ভয় পেলেও, এইগুলো সব শুধু গল্প, সত্যি সত্যি এসব কিছুই তোদের সঙ্গে কখনো হবে না। গল্প শেষ হলে তোরা ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবি, তাই না!" আকাশের কথা এখনো বাকি ছিল।

"একদম ঠিক!" কৌস্তভ বলল, আকাশকে একটু রাগানোর সুযোগটা ছাড়া যায় না।

 

"একদম ভুল।" আকাশ থামাল ওকে। "হতে পারে, এর থেকে অনেক ভয়াবহ ব্যাপারও হতে পারে। আর যেদিন সত্যি সত্যি ভয় পাবি আর কখনো ভূতের গল্প শুনতে চাইবিনা।"

 

ওর আওয়াজে কি যেন একটা রহস্য ছিল... সবাই একটুক্ষণ চুপ করে গেল। তারপর পৃথ্বী হঠাৎ বলে উঠল, "বললাম না, ও শুধু ফুটেজ খাচ্ছে! বেশ গল্পগুলো জমে উঠেছিল, ধুর্!"

 

এবার একটু সহজ হয়ে রিতমা আবার ধরল, "এই, তুই ভাষণ ছেড়ে গল্পটা বল না তোর সেই বিশাল ভয়ের গল্প!"

"হ্যাঁ, টাইম ওয়েস্ট করিস না তো!" সুদীপ্তা যোগ দিল সেই সুরে।

"আমি নাহয় শুরুটা ধরিয়ে দিচ্ছি..." গম্ভীর মুখে বলল কৌস্তভ, "একদিন একটা শ্মশানে..."

"না না, শ্মশান কবরস্থান অনেক হয়েছে!" প্রতিবাদ করল সুদীপ্তা।

"তাহলে পুরোনো একটা বাংলো?" পৃথ্বী যোগ দিল ঠাট্টাতে।

"না না সেটাও এখন পুরোনো!" খিলখিল করে হেসে উঠ্ল রিতমা।

"তাহলে, তাহলে... একটা..." শব্দ খুজ্ছিল কৌস্তভ।

 

"...লেক।" বলে উঠ্ল আকাশ, একটু মুচ্কি হেসে।

"লেক?" একটু থতমত খেল কৌস্তভ, তারপর বলল, "তা বেশ, এগিয়ে যাও বাছা।"

 

সবাই এবার একটু এগিয়ে বসল আকাশের দিকে। ঠাণ্ডা আরো বেড়েছে, পাশে আগুন হওয়া সত্তেও আর গায়ে মোটা জ্যাকেট বা পুলওভার থাকা সত্তেও, সবাই একটু একটু কাঁপছে। লেকের জলের ছোঁয়া লেগে ঠাণ্ডা হাওয়া একটু একটু থেকে সবাইকে সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছে।

 

"জলের সঙ্গে অপার্থিব দুনিয়ার একটা যোগাযোগ আছে, জানিস কি?" আকাশ আনমনে বলতে শুরু করল। "দেখ্বি, জল সবরকম পূজো-আর্চার কাজে ব্যাবহার হয়, দাহের সময়েও। শুধু হিন্দু ধর্মে নয়, অনেক ধর্মেই জলের প্রয়োগ দেখ্তে পাবি। খ্রীস্টান ধর্মে হোলি ওয়াটারের কন্সেপ্ট আছে, শুধু চার্চে নয়, কোনো অশুভ আত্মাকে তাড়ানো, যাকে বলে এক্সোরসিসম, সেখানেও এটা ব্যাবহার হয়।"

 

পৃথ্বী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হাত ধরে থামাল রিতমা।

 

আকাশ বলে চলল, "জলের আসলে পার্থিব আর অপার্থিব দুই গুণই আছে। আমাদের সৃষ্টির সঙ্গেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িত তো, তাই জল এই দুই দুনিয়ার মধ্যে একটা সেতুর মতো কাজ করে। অশরীরিরা অনেক সময়ে এই জলের মাধ্যমেই এক দুনিয়া থেকে আরেক দুনিয়ায় যাতায়াত করে।"

 

"সেকি, টিকিট লাগে না?" কৌস্তভ না বলে পারল না।

সবাই হাসি চাপার চেষ্টা করছিল, কিন্তু আকাশ মুচ্কি হেসে বলল, "না, আমাদের টিকিট লাগে না।"

 

"ওহ্! এই ব্যাপার্! স্যার বুঝি তেনাদের দুনিয়া থেকে এয়েছেন্!" কৌস্তভ চোখ বড় বড় করল।

"বাবারে! সত্যি আকাশ! খুব ভয় পেয়ে গেছি রে!" রিতমাও গম্ভীরভাবে বলে উঠল, আর তারপর থাকতে না পেরে হেসে ফেলল।

 

"গল্প তো সবে শুরু রে!" আকাশ বিদ্রুপটা গায়ে মাখল না। "আজ তোদের ভয় পাবার সব শখ পুরো হয়ে যাবে। সেজন্যই তো আমার আসা।"

"এক মিনিট, হোল্ড প্লিজ্!" পৃথ্বী একটু বিরক্ত। "তাহলে তুই বলতে চাস্, তুই একটা ভূত?"

"এই শব্দটা আমাদের ঠিক পছন্দ না। অশরীরি, আত্মা বা স্পিরিট বলতে পারিস্।"

"ধুর্, জ্ঞান দিস না তো মাইরি! মোদ্দা কথা হল তুই অক্কা পেয়েছিস্, তাই তো? তুই ইহজগতে নেই, তোর সোল হ্যাস ডিপার্টেড্, ঠিক ?"

 

আকাশ কিছু না বলে শুধু মুচ্কি হেসে মাথা নাড়াল।

"আরে, ও মজা করছে! তুই ক্ষেপছিস কেন?" সুদীপ্তা পৃথ্বীকে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করল।

"রাগিস না রে, আমার ওপরে রাগ করে তোর আর লাভও নেই অবশ্য।" আকাশ এবার ম্লান মুখে বলল।

 

"দেখ্লি, দেখ্লি? এখনো আগের ট্র্যাকেই আছে!" পৃথ্বী এই ঠাণ্ডাতেও লাল হয়ে যাচ্ছিল। "আচ্ছা, তার মানে তুই একটা ভূত, ইয়ে আত্মা, আমাদের সঙ্গে দিব্বি গাড়িতে বসে ব্যাঙ্গালোর থেকে কোড়াইকানাল এলি, রাতে হোমস্টেতে থাকলি, খেলি দেলি, আর এখন লেকের ধারে বসে আড্ডা দিচ্ছিস্, তাই তো?"

 

"এখানে আসা অবধি তো সব ঠিকই ছিল রে!" আকাশ লেকের দিকে তাকাল, তার আওয়াজ আরো ভারী হয়ে উঠছে একটা অদ্ভুত ব্যাথায়। "কাল হল এখানে এসে, এই অন্ধকারে মিশে থাকা অদ্ভুত মায়াভরা লেকটায়্।"

 

"তুই কি যাতা বলে যাচ্ছিস্, বল তো?" এবার কৌস্তভও রেগে উঠ্ল।

"একটা কথা বলি?" রিতমা ইতস্তত করে বলল। "ও কিন্তু একটু আগে একা জঙ্গলের দিকে গেছিল, হালকা হতে।"

"তার মানে?" পৃথ্বী যেন এবার ফেটে পড়বে। "ও মূত্রত্যাগ করতে গিয়ে দেহত্যাগ করে চলে এল?"

 

আকাশ উঠে দাঁড়াল। তারপর বিষণ্ণ মুখে বলল, "দেখ্বি? দেখ্বি আমার বডিটা?"

কেউ কিছু বলে ওঠার আগেই ও পা বাড়াল লেকের ধার দিয়ে জঙ্গলের ভেতরের দিকে, "ওইখানে আছে।"

 

"এই ইডিয়েট, কোথায় চললি তুই?" কৌস্তভও রেগে উঠে দাঁড়াল।

"আকাশ, এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে!" সুদীপ্তাও যোগ দিল।

"এই, তোরা দ্যাখ্! ওর ছায়া পড়ছেনা কিন্তু!" রিতমা আঁতকে উঠে আঙ্গুল দেখাল মাটির দিকে।

 

"কি বলছিস্?" কৌস্তভ একটু থতমত খেয়ে নীচে তাকাল। সত্যি কোনো ছায়া ফেলছিল না আকাশের অবয়ব।

কৌস্তভ তাও নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল, "ধুর্, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, আগুনের আলো অতদুর যাচ্ছেওনা, ছায়া কোত্থেকে পড়বে? তুই না!"

 

পৃথ্বী আবার সাহস ফিরে পেল, সঙ্গে তার রাগও, "আকাশ, তুই এক্ষনি ফিরে আয় বলছি! নাহলে তোকে মেরে আমি-ই ভূত বানাব বলে দিলাম!"

"যদি ও অলরেডি ভূত না হয়ে গিয়ে থাকে।" সুদীপ্তা চিন্তিত মুখে তাকাল বন্ধুদের দিকে।

 

আকাশ কিন্তু হেঁটেই চলেছে ধীরপায়ে, একটু একটু করে তার শরীরটা যেন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে।

"ব্য়াটা যাচ্ছে কই?" কৌস্তভ এদের মধ্যে সবথেকে সাহসী, ওই হাঁটা শুরু করল আকাশের পেছন পেছন। আকাশ তখন ওদের থেকে ৩০-৪০ ফুট এগিয়ে।

বাকিরা বেগতিক দেখে পিছু নিল কৌস্তভের।

 

"দাঁড়া আকাশ, এত রাতে জঙ্গলের ভেতরে গেলে হারিয়ে যেতে পারি, ফিরে আয়!" কৌস্তভ হাঁক মারল।

"চলে এসেছি রে, এই তো এখানে।" বলে আকাশ যেন আরো দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে লাগল।

"কি মুশ্কিল!" বাধ্য হয়ে কৌস্তভ এবার দৌড় মারল আকাশের দিকে। পেছন পেছন বাকিরাও।

 

জঙ্গলটা যে এত ঘন, বাইরে থেকে বোঝা যায় না। মনে হচ্ছিল যেন একটা কালো ব্লটিং পেপার শুষে নিয়েছে এই পৃথিবীর সব আলো, যেন এখন সূর্য উদয় হলেও তাকে দেখা যাবে না।

 

আকাশকে আর দেখা যাচ্ছিল না। একটা জায়গায় এসে কৌস্তভ দাঁড়িয়ে পড়ল। আর এগোনো বোকামি হবে।

"কি হল, দাঁড়িয়ে গেলি যে?" একটা অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠল রিতমা। তারা সবাই এখন কৌস্তভের কাছে।

"আকাশ, আকাশ!" উত্তর না দিয়ে চেঁচাল কৌস্তভ। কেউ জবাব দিল না।

নিজের ফোনের টর্চ লাইটটা জ্বালাল পৃথ্বী। আলোটা এমনিতে জোরালো, কিন্তু এই অন্ধকারে যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছিল সেটাও।

 

বাকিরাও তাদের ফোনের টর্চগুলো জ্বালিয়ে ভয়ে ভয়ে ডাক দিল, "আকাশ, আকাশ!"

কিন্তু আকাশ কোথায়? কেউ কোত্থাও নেই। শুধু তাদের আওয়াজে বিরক্ত হয়ে কয়েকটা বাদুড় উড়ে চলে গেল পাশের গাছ থেকে।

"ওরে বাবারে!" বলে মাটিতে বসে পড়ল রিতমা। তার হৃৎপিণ্ডটা এত জোরে ধুকপুক করছিল যেন বুক চিরে বাইরে বেরিয়ে আসবে।

 

"আমাদের মনে হয় সত্যিটা মেনে নেওয়া উচিত এবার।" ধীর গলায় বলল সুদীপ্তা।

"কি সত্যির কথা বলছিস তুই?" পৃথ্বী রাগ দিয়ে নিজের ভয়টা ঢাকার চেষ্টা করল। "জলজ্যান্ত একটা মানুষ হঠাৎ ভূত হয়ে গেল? এ কি বলে রে কৌস্তভ?"

কৌস্তভ কোনো কথা না বলে একটু এগিয়ে চারদিকটা দেখল। অন্ধকারে কিছুই বোঝার উপায় নেই। টর্চের আলোয় শুধু ঘাপটি মেরে থাকা ঝোপঝাড়গুলো দেখা যাচ্ছিল।

 

"তুই শুধু শুধু রেগে যাচ্ছিস কেন? আকাশ কোথায়? আকাশকে দেখ্ছিস কোথাও?" সুদীপ্তা হাত তুলে দেখাল চারদিকে।

"তার মানে, ও মরে গেছে? এটাই বলতে চাইছিস তুই?" পৃথ্বী ব্যাপারটা এখনো বিশ্বাস করতে পারছিল না।

"আমাদের ফেরত যাওয়া উচিত।" শান্ত গলায় বলল কৌস্তভ।

"চলে যাব? আর আকাশ? ওর কি হবে?" পৃথ্বী অবাক হয়ে বলল।

"ওর যা হওয়ার... তা তো হ​য়ে গেছে রে!" রিতমার কান্না পাচ্ছিল​।

পৃথ্বী অবাক হ​য়ে সবাইকে দেখছিল​। "তাহলে... আকাশ​...?"

 

"আকাশ নেই!!! কথাটা বুঝছিস না কেন​?" চরম কষ্টে চেঁচিয়ে উঠল কৌস্তভ​। খুব অসহায় লাগছিল তার​।

পৃথ্বী মুখ কালো করে মাটির দিকে তাকাল​।

 

"ওকে ফেলে যাচ্ছি না। কিন্তু এই অজানা অচেনা জায়গায়​, এই জঙ্গলে, অন্ধকারে আমরা কোথায় খুঁজব ওকে? সেই বিপদ তো আমাদেরও হতে পারে। তার চেয়ে ফিরে গিয়ে পুলিশে রিপোর্ট লেখানো বেশি ভাল হবে।"

পৃথ্বী তখনো নীচে তাকিয়ে ছিল​।

কৌস্তভ ওর কাঁধে হাত রাখল​। "চল্। ফেরত চল্।"

 

একে অপরের হাত ধরে তারা ফেরার রাস্তা ধরল​। আগুনটা মনে হ​য় নিভে গেছে। লেকের কাছে আর কোনো আলো নেই। মেঘের ফাঁক দিয়ে চাঁদের ক্ষীণ আলো লেকের জলে কোথাও কোথাও প​ড়ে আরো রহস্যম​য় দেখাচ্ছিল​।

 

জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরোতে এখনো ক​য়েক গজ বাকি ছিল​। হঠাৎ রিতমা দাঁড়িয়ে প​ড়ল​।

"কি হল​..." কৌস্তভ কথা শেষ করতে পারল না... পৃথ্বী তার হাত ধরে একটা হ্য়াঁচকা টান দিয়ে নিজেও দাঁড়িয়ে প​ড়ল​। রিতমা তখন ঠকঠক করে কাঁপছে।

"তোরা কি এটা দেখতে পাচ্ছিস্?" সুদীপ্তা আঙ্গুল তুলে একদিকে দেখাল​। না দেখালেও চলত​। সামনে জঙ্গল যেখানে শেষ​, দুটো লম্বা গাছের ঠিক মাঝখানে, একটা ছায়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল​।

 

ছায়া বলা ভুল​। ছায়ার জন্য কায়া থাকতে হ​য়​। তারা যেটা দেখল তার কোনো কায়া নেই, হ​য়তো কোনোদিনও ছিল না। মাটি থেকে একটা কালো ধোঁয়ার মত কি যেন আস্তে আস্তে ফুলে ফেঁপে একটা আকার ধারণ করার চেষ্টা করছিল​। সেই আকার একটু একটু মানুষের মত হলেও, ঠিক যেন তা ন​য়। মানুষের আকারে যেন আরো কিছু আকার ঢুকে জায়গা দখল করার চেষ্টা করছিল​... যেন এই জঙ্গলে যত মানুষ জন্তু জানোয়ার প্রাণ হারিয়েছে সবাই ওই ধোঁয়ার রঙে নিজেকে তাড়াতাড়ি এঁকে ফেলতে চায়​। ধোঁয়ার অশরীরি শরীরটা মোচ​ড় খেয়ে যাচ্ছিল সেই সব আকার ধরে রাখার চেষ্টায়​।

 

খুব বেশী ভ​য় পেলে আমরা অনেকসম​য় এমন কিছু করে বসি যার কোনো মানে হ​য় না। সুদীপ্তা তাই করল​। ওর টর্চের আলোটা ছায়ার উপর ফেলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল​, "কে? কে ওখানে?"

 

একটা বিকট চিৎকার করে কেঁপে উঠল ছায়াটা, তার ধোঁয়ার শরীরে একটা ঢেউ খেলে গেল​... যেন এই বিভীষণ জঙ্গলের সব অপ্রাকৃতিক বাসিন্দা একটা সম্মিলিত ব্য়াথায় একসাথে গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠল​, আর সেই অদ্ভূত রক্ত জল করা আওয়াজ বেরিয়ে এল ওই ছায়ার মধ্যে থেকে। আর সঙ্গে সঙ্গে ছায়াটা টুকরো টুকরো হ​য়ে ওদের দিকে ছিটকে এল​।

 

"ওমাআআআআআগোওওওওও..." বলে উল্টো দিকে দৌড় দিল রিতমা।

আর কিছু বলতে হল না। পৃথ্বী আর সুদীপ্তা এবার দিকবিদিক ভুলে দৌড় দিল​।

"কোথায় যাচ্ছিস​? ওদিকে জঙ্গল​! দাঁড়া!" বলে কৌস্তভও দৌড়ল ওদের পিছনে।

 

জঙ্গলের মধ্যে চারদিকে গাছগাছালি ঝোপঝাড় পাথর​। মাটিটাও উঁচু নিচু। ভ​য়ে আর দৌড়ের বেগে টর্চের আলো ঠিক করে কোথাও ফেলা যাচ্ছিল না। বিপদ তো হবারই কথা ছিল​।

 

একটা শিক​ড়ে হোঁচট খেয়ে মুখ থুব​ড়ে প​ড়ল পৃথ্বী। ব্যাথা পাবার ভ​য়ে ও আগেই চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল​, কিন্তু ব্যাথা তেমন লাগল না। ও টের পেল ও প​ড়েছে একটা নরম কিছুর ওপরে... একটা দেহ​।

 

চোখ খুলে কাঁপা কাঁপা হাতে টর্চের আলো ফেলল ও শরীরটার ওপর। আরে, এটা তো খুবই চেনা চেনা...

"লাআআআআশ​! আকাশের লাশ​!" পেছনের দিকে ছিটকে গিয়ে প্রাণপণ চেঁচাল পৃথ্বী।

 

লাশটা আস্তে আস্তে উঠে বসতে লাগল​। পৃথ্বী মাটিতে বসা অবস্থাতেই চেঁচাতে চেঁচাতে পেছনের দিকে নিজের শরীরটাকে হিঁচ​ড়ে নেয়ে যাচ্ছিল​।

"লাআআআআআআআশ​!"

"কই, কোথায় লাশ​?" আকাশের লাশ ভ​য়ে এদিক ওদিক তাকাল​।

"মানে? তু...তুই লাশ​! আর কে!" পৃথ্বী ভয়ে ভ​য়ে একটা মৃদু ধমক দিল​।

"আমি লাশ হতে যাব কোন দুঃখে?" এবার রাগার পালা আকাশের​। মাথায় হাত বুলিয়ে বিরক্ত সুরে বলল​, "মাথাটা ফেটে মনে হ​য় চৌচির হয়ে গেছে, উনি এদিকে লাশ লাশ বলে চেঁচাচ্ছেন​!"

 

ওদের আওয়াজে ততক্ষণে বাকিরা এখানে ছুটে এসছে।

"আ...আকাশ​?" রিতমা যেন আকাশ থেকে প​ড়ল​।

"তুই তো মরে গেছিলি..." কৌস্তভ টর্চের আলো আকাশের মুখে ফেলল​। কপালের কাছটায় একটু কেটে রক্ত বেরোচ্ছিল​।

"তোকেও কি ওই ছায়াটা ধরেছিল​? তোকে গিলে ফেলতে চাইছিল​?" সুদিপ্তা ওর কাছে বসে ওর কাঁধে হাত বোলাল​।

"ছায়া? কিসের ছায়া? তোদের থেকে লুকোতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে প​ড়লাম​... তারপর কিছু মনে নেই।"

 

হঠাৎ করে পৃথ্বী লাফিয়ে প​ড়ল আকাশের ওপর​, আর ওর গলা টিপে ধরল​, "ইডিয়েট​, লুকোচ্ছিলি আমাদের থেকে? এই জঙ্গলে? ইয়ার্কি মারার জায়গা পাসনি? কিছু হ​য়ে গেলে কি করতি?"

"এই ছাড় ছাড়​!" কৌস্তভ ওকে টেনে তুলল​।

"তোকে শালা আমি-ই মেরে ফেলব​! এবার সত্যি ভূত হবি তুই!" পৃথ্বী তখনো রাগে ফুসছিল​।

 

"তুই কখন থেকে একটার পর একটা গল্প শুনিয়ে যাচ্ছিলি, যেন সব ধরণের ভূতের খবর তোর কাছেই।" আকাশ মাথার রক্তটা হাতে নিয়ে দেখল​। "তাই ভাবলাম​, আমি একটু আসল ভ​য়ের স্বাদ​... ওটা কি????"

আকাশের আচম্কা চিৎকারে সবাই ঘুরে তাকাল​। সেই ছায়া। জমাট বাধা ধোঁয়ায় গ​ড়া বিচিত্র বিকটাকার ছায়া।

"এটা আসল ভূত​।" সুদীপ্তা ফিসফিস করে বলল​।

 

সবাই ভ​য়ে সিঁটিয়ে জ​ড়ো হ​য়ে দাঁড়াল​। ছায়াটা মোচ​ড় খেতে খেতে ওদের দিকে এগোতে লাগল​, যেন তার অসংখ্য় আকারে তাদেরও শামিল করে নিতে চায়।

"আবার দৌড়ই?" রিতমা পিছিয়ে যেতে যেতে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল​।

"কোনো লাভ নেই। এটা ওর এলাকা।" কৌস্তভ পেছোতে পেছোতে বলল​। আকাশকে ফিরে পেয়ে সবাই যেন একটু মনোবল পেয়েছিল​। "আমাদের গাড়ির কাছে পৌঁছতে হবে।"

"প্ল্য়ানটা কি?" আকাশ সবার দিকে তাকাল​।

"তোকে পিটিয়ে ভূত বানাবার​।" পৃথ্বী ফিসফিস করে জবাব দিল​।

"আমি জানি কি করতে হবে।" সুদীপ্তা কথা না বাড়িয়ে ওর টর্চের আলো ছায়াটার ওপর ফেলল​।

 

সেই বিকট চিৎকারে গমগম করে উঠল জঙ্গলটা। ছায়াটা আবার ছ​ড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে লাগল​।

 

"গুড আইডিয়া! সবাই টর্চ মার ওটার ওপর​!" কৌস্তভ তার আলোটাও ছায়াটার ওপর ফেলল​। সাথে সাথে বাকি তিনজনও।

ছায়ার বীভ​ৎস চিৎকারে ভরে গেল রাতের আকাশ​। সদ্য ঘুম ভেঙে ওঠা পাখির এক ঝাঁক ভ​য়ে চেঁচাতে চেঁচাতে ক​য়েকটা গাছ সজোরে দুলিয়ে পালিয়ে গেল ওখান থেকে। ছায়াটা তখন ছিন্নবিছিন্ন হয়ে নানান দিকে ছিট্কে যাচ্ছিল​।

"এবার দৌড় দে!" বলে কৌস্তভ ছুটতে শুরু করল জঙ্গলের বাইরের দিকে। পেছন পেছন বাকিরাও।

 

ছায়ার টুকরোগুলো তখনো ব্যাথায় কাতর​, নিজেদের আবার জুড়ে নেবার একটা ক্ষীণ চেষ্টা করছিল​। কিন্তু সেসব দেখার সম​য় ছিল না কারো কাছে। সবাই প্রাণপণ ছুটতে লাগল লেকের দিকে।

 

জঙ্গলটা শেষ হ​য়ে গেছিল​। তারা তখন লেকের ধার ধরে দৌড়চ্ছে। ছায়া আদৌ ওদের পিছনে আসছে কিনা সে দেখার সাহস তখন কারো নেই।

"জল নাকি সেতু!" দৌড়তে দৌড়তেও বিড়বিড় করছিল পৃথ্বী। "তোকে এই জলে ডুবিয়ে দিয়ে দেখি সেতু ধরে কোন দুনিয়ায় যাস তুই।"

"সেটা তো এমন একটা ভুল বলিনি।" আমতা আমতা করে প্রতিবাদ করল আকাশ​।

"তুই নিজেই একটা আস্ত ভুল​। তোকে হোমস্টের বিছানায় বেঁধে পেটাব​!"

 

"ফোকাস ফোকাস​!" বলে কৌস্তভ দৌড়তে দৌড়তে পকেট থেকে গাড়ির রিমোট চাবিটা বের করল​। তারা তখন গাড়ির প্রায় কাছে চলে এসেছে।

আকাশ টেন্টের দিকে ছুটে গেল​।

কৌস্তভ তখন গাড়িতে পৌঁছে গেছে। দরজা খুলতে খুলতে চেঁচাল সে, "কি করছিস তুই গবেট​?"

"আরে টেন্টটা প্যাক করতে হবে তো!" অবাক হ​য়ে জিজ্ঞেস করল আকাশ​।

"তুই কি পাগল হ​য়ে গেছিস​? ওটা ভাঁজ করতে এখন আধঘণ্টা লাগবে!" দাঁত খিচিয়ে বলল কৌস্তভ। "শিগ্গির আয়​!"

সবাই তখন গাড়িতে উঠে প​ড়েছে। আকাশও অগত্য়া প​ড়িম​ড়ি করে উঠে বসল পেছনের সিটে। গাড়ি স্টার্ট হ​য়ে গেছিল​। সঙ্গে সঙ্গে এক্সিলেটরে পা রাখল কৌস্তভ​।

 

রাতের অন্ধকার চিরে কৌস্তভের গাড়ির হেডলাইটের আলো পথ দেখাতে লাগল​।

ক​য়েক মিনিট সবাই চুপচাপ বসে রইল। ছায়াটা লেকের ধারে ফেলে এলেও, ওর ভ​য় এখনো ওদের সঙ্গে ছিল​। আকাশ ভুল বলেনি, আজ ভ​য়কে এত সামনে দেখে ভূতের গল্পের নাম নিতেও যেন ইচ্ছে হচ্ছিল না কারো।

 

গাড়ির পরিবেশ তখনো থমথমে। কে কি বলবে বুঝে পাচ্ছিল না। বিশেষ করে আকাশ​। একটা ব​ড় বিপদ হ​য়ে যেতে পারত তার এই ফাজলামোর জন্য​। ধুর​, কেন যে ব্যাপারটা তার মাথায় এল​!

 

"সত্যি আকাশ​।" রিতমা ওর হাতে হাত রেখে বলে উঠল​। ওর মুখে ম্লান হলেও একটা তৃপ্তির হাসি। "খুব ভয় পেয়ে গেছি রে!"

 

কয়েক সেকেণ্ড সবাই রিতমার দিকে তাকাল​... তারপর হাসিতে গ​ড়িয়ে প​ড়ল​।

এডভেঞ্চারটা মোটামুটি সফলই বলা চলে।

 

~~~সমাপ্ত​~~~

Enjoy this post?

Buy sharitsrealm a coffee

More from sharitsrealm